Social Stories, Stories

অভিশপ্ত মাতৃত্ব – তমোঘ্ন নস্কর

ওঁয়া ওঁয়া ওঁয়া…মায়ের শুকনো স্তন প্রাণপনে টানতে টানতে কেঁদে চলেছে শিশুটি। হাত পা ছুঁড়ে পুরো পৃথিবী কে জানাচ্ছে তার অভিযোগ ; “ আমার খিদে পেয়েছে গো! আমাকে খেতে দাও! ”
কিন্তু খেতে দেবে কে? যে খেতে দেওয়ার মালিক সেই চলে গেছে কয়েকঘন্টা আগে। টানা পাঁচদিন অভুক্ত ছিল সুন্দরী। সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল সুন্দরীর। ওই দুর্বল শরীরে পাঁচ দিন এর অভুক্তি নিতে পারেনি। নিঃশব্দে প্রাণটা বুকের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে গেছিল। শেষ মুহূর্ত অব্দি শূন্য ভিটেতে আগলে ধরেছিল সন্তানকে…
দাবার নিচে শেয়ালগুলো জুলজুলে চোখে তাকিয়ে আছে শিশুটার দিকে। আর একটু পর, তারপরেই…
***
১৯৩৭ এর খরা! হরিরামপুর, মুক্তারামপুর এ একটি বটগাছও বাছেনি। বাদুড় পর্যন্ত মরে বিছিয়ে রয়েছে গাছের তলায়। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে। শাক ভেবে বুনোপাতার, বিচুটির রস খেয়ে মরেছে কতজন! কতজন জেনেশুনে ওই খেয়েই আত্মহত্যা করেছে!
সুন্দরী শ্বশুর-শাশুড়ি ও তাদের মধ্যেই পড়ে। অথচ এই কয়দিন আগেই তাদের ভিটে তার ঝলমলে ছিল। লাতি হবে বলে সবদিকে ঘুরে ঘুরে বলে বেড়াত তার শউর। কিন্তু বৈশাখের শুরু থেকে সেই যে গরম দিল এই ভাদ্দরে ধরে এসেও… দানা বোনা তো দূর, তেস্টার জল টুকু নেই!
সব উজাড় হয়ে গেছে। মেয়ের মুখ দেখে সুন্দরীর বর গেছিল চাল আনতে, পথেই রক্ত বমি দে মারা গেছে।
গ্রামের মানুষ যারা আছে তারা কেউ সুন্দরীদের ভিটের দিকে আসে না! সবাই বলে শিশুটি ডাইনি, অপয়া। ও সব্বাইকে খেয়ে নেবে। আস্তে আস্তে পুরো ভিটে উজাড় হয়ে গেছে। এমনকি সুন্দরীর যখন শ্বাস উঠেছে তখনও জ্ঞাতিগুষ্টি কেউ ধরতে আসেনি। নিঃশব্দে প্রাণপাখি বেরিয়ে চলে গেছে …
***
হরিমতির বাস গ্রামের বাইরে। গ্রামের লোক তাকে ঠেঙিয়ে গ্রামের বাইরে বের করে দিয়েছে। হরিমতি নাকি ডাইনি! লোকের বাচ্চার দিকে তাকালে বাচ্চার পুঁয়ে রোগ ধরে , পূর্ণ মরদের দিকে তাকালে মরদ শুকিয়ে যায়, পূর্ণ গর্ভার দিকে তাকালে তার গর্ভপাত হয়ে যায়। আরো কত কী? বাতাসে ভেসে বেড়ায়…
তাকে তো সবাই পুড়িয়েই মেরে ফেলতে পারত। শেষমুহূর্তে কেন যে বাঁচিয়ে রাখলো? নিজের অমন দুটো ফুটফুটে ছেলে চলে যাবার পর বারবার ভাবে হরিমতি!
উত্তর পেয়ে গেছে এখন; ভূখ মেটাতে!
তর্করত্ন, চৌধুরী, হালদারের পো-র মাগনার শরীর সে। ঘরের বউয়ে যখন তাদের মুখ মরে যায়। হরসুন্দরীর ভিতরে ঢোকে, তাকে ইচ্ছামত ভোগ করে। ডাইনি হরিমতির কথা কে-ই বা শুনবে? কেউ শুনবে না, বারবার গর্ভপাত করাতে করাতে ক্লান্ত হরিমতি।
***
এখন গ্রাম ফাঁকা ফাঁকা। লোকজন সব ভেগেছে। ঘর বাড়ি খোলা রেখেই ছেড়ে চলে গেছে। মাঝে মাঝে হরিমতি এর ওর বাড়িতে ঢুকে খাবার-দাবারের খোঁজ করে। নয়তো কাঁথা-লেপ বের করে নিয়ে আসে। আজ দ সুন্দরীর দাবায় উঠে অবাক হয়ে দেখল, স্থির নিস্পন্দ মা আর শিশুটি! বাচ্চাটার গলার স্বর, গতি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
শিশুর মা’য়ের খোলা মুখ থেকে মাছি এসে বসছে শিশুটির গালে। কান্না আরও আরও তীব্র হয়।
বিশেষ কিছু ভাবতে পারল না হরিমতি। শাড়ি নামিয়ে আপন স্তনখানি চেপে ধরল শিশুর মুখে! শিশু টানে এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত… অকাল শ্রাবণের ধারা নামলো যেন!
উম্ম উম্ম করে আওয়াজ করে শিশু, হরিমতি ডাইনি থেকে মা হয়!
সে রাতে বৃষ্টি নামে গ্রামে, টানা তিন দিন চলে বৃষ্টি!
ডাইনির বুকের দুধে মরা শিশু বাঁচে! ডাইনি কষ্ট পেলে আকাশও বৃষ্টি নামায়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *