বাবার মৃত্যুর পর দশ বছর কেটে গেছে। স্মৃতিভ্রংশের (ডিমেনশিয়া) যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট ছিলেন বাবা। জীবনের শেষ দিনগুলিতে আমার নামটিও ভুলে যেতেন, যা আমার জন্য সবচেয়ে বেদনাদায়ক স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে স্টক মার্কেটের চাপে এতটাই বিপর্যস্ত ছিলাম যে শরীর ভালো যাচ্ছিল না। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, “টানা দুই সপ্তাহ সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে।” একঘেয়েমির মাঝে বেঁচে থাকতে, বাবার লাইব্রেরিতে পুরনো বইগুলো পরিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমি বইটা স্পর্শ করতেই, আমার অসাবধানতায় সেটা হাত ফসকে নিচে পড়ে গেল। আর ঠিক তখনই, তার ভেতর থেকে একটা কাগজ বেরিয়ে মাটিতে পড়ল।
চমকে উঠে মাটিতে পড়ে থাকা কাগজটা তুলে দেখলাম ওটা বাবার হতে লেখা চিঠি!
⤮★⤮★⤮★⤮★⤮★
আজ শরীরটা ভালো লাগছে না। সে যাই হোক, আমি অভ্রর সঙ্গে কথা বলার ভাবছিলাম।
নন্দিনী চলে যাবার পর অভ্র ছাড়া আমার আর কেই বা আছে। কিন্তু এই ঘটনাগুলো এমন কিছু নয় যা একজন ১১ বছরের শিশুকে বলা যায়। তাই এই চিঠিগুলো লিখছি। এইভাবে যদি ভবিষ্যতের অভ্রের সাথে কথা বলা যায় !
চোখ বন্ধ করলেই অদ্ভুতভাবে সম্পূর্ণ অন্ধকার দেখি, আর অনেক দূরে দুটো চোখ রাগান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি বিশাল এক কালো সাগরের ওপর দিয়ে হাঁটছি, কিন্তু সেই সাগরে কোনো ঢেউ নেই। চারপাশে শুধু গভীর কালো অন্ধকার। আর আমি যতই হাঁটি, সেই চোখগুলোর দূরত্ব কখনও কমে না।
এই কারণে ঘুমাতে ভয় লাগছে। তবুও, এখন একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে দেখি। তারপর চিঠি লিখতে লিখতে ঘুম ঠিক চলে আসবেই।
কথিত আছে, যখন একজনের কোনো ইন্দ্রিয় হারিয়ে যায়, অন্য ইন্দ্রিয়গুলোর শক্তি তীব্রতর হয়ে ওঠে। এ কারণেই আমরা অনেক অন্ধ ব্যক্তির মধ্যে চমৎকার ঘ্রাণশক্তির নজির দেখি। ধর্মীয় ব্যাখ্যায় বলা হয়, পরম শক্তি অর্থাৎ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জাগ্রত করতে হলে প্রথমে সব পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে বিসর্জন দিতে হয়। একমাত্র এই পথেই ঈশ্বরপ্রাপ্তি সম্ভব।
স্বাভাবিকভাবে একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে এমন ধ্যানের স্তরে পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন, যেখানে ইচ্ছেমতো ইন্দ্রিয়গুলিকে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করা যায়। কিন্তু যদি কল্পনা করা হয়, সার্জারির মাধ্যমে এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, তাহলে কী হতে পারে?
প্রথমেই বলা প্রয়োজন, মানব শরীরের ইন্দ্রিয়গুলি আমাদের অস্তিত্বের গভীরতম ভিত্তি। দৃষ্টি, শ্রবণ, স্বাদ, স্পর্শ ও ঘ্রাণের বিচ্ছিন্নতা মানে এক ধরণের সম্পূর্ণ বোধহীনতা। বিজ্ঞান অনুযায়ী, ইন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে মস্তিষ্কে সঞ্চারিত সংকেতই আমাদের উপলব্ধির কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়। যদি এই সংকেত একেবারে কেটে দেওয়া হয়, মস্তিষ্ক স্থবির অবস্থায় পৌঁছাতে পারে। এমনকি এ ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্নতা মস্তিষ্কের সজাগ ভাবের সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটাতে পারে, যেখানে মানসিক অস্থিতিশীলতা, গভীর অবসাদ বা পুরোপুরি অচেতন অবস্থা দেখা দেওয়া সম্ভব।
এছাড়া, ইন্দ্রিয় বিচ্ছিন্ন করা হলে মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যও মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। শরীরের বোধ ও অভিজ্ঞতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা মানে আত্ম-সচেতনতা এবং অস্তিত্বের বাস্তবতা হারানো। এর ফলে এক ধরণের আত্ম-বিদ্রোহ বা চেতনাহীনতার সৃষ্টি হতে পারে যা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতাকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করতে পারে।
১৯৮৩ সালের কথা।
ধর্মবিশ্বাসে নিবিষ্ট কিছু বিজ্ঞানী এক সাহসী এবং অনন্য পরীক্ষা করলেন, কোথাও এক রহস্যে ঘেরা গবেষণাগারে। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভবের পথে বাধা। যদি কোনোভাবে সেই ইন্দ্রিয়গুলোকে স্থগিত করে রাখা যায়, তবে হয়তো মানুষ তার চিন্তাশক্তির মাধ্যমে সরাসরি সৃষ্টিকর্তার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হবে।
এই তত্ত্ব পরীক্ষার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পাওয়া গেলেন এক বৃদ্ধ, যিনি বলেছিলেন, “বাঁচার আর কোনো কারণ নেই আমার।” বিজ্ঞানীরা একটি জটিল শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে তাঁর মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযুক্ত সব ইন্দ্রিয় নার্ভ কেটে দেন। ফলে তাঁর দেহের সমস্ত অনুভূতি নিস্তেজ হয়ে যায়—চোখ অন্ধ, কান বধির, জিহ্বা স্বাদহীন, নাসা গন্ধবর্জিত এবং ত্বক অনুভূতিহীন।
বাইরের পৃথিবীর সাথে সমস্ত যোগাযোগের সেতু ছিন্ন হয়ে গিয়ে তিনি নিজেকে এক নিঃসঙ্গ চিন্তাজগতের বন্দি হিসেবে আবিষ্কার করলেন। বাস্তবিক, এটি ছিল তাঁর আত্মার অন্তর্লীন জগতের রহস্যে প্রবেশ করার একটি পথ।
বিজ্ঞানীরা তার প্রতিটি পদক্ষেপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। যেহেতু সে নিজের অবস্থার বর্ণনা করছিল অস্পষ্ট, জড়ানো বাক্যে যা তার কানে পৌঁছাতই না। প্রথম চার দিন ধরে, তিনি জানান, তার মাথার ভেতরে যেন ফিসফিস শব্দ শোনা যাচ্ছে—অস্পষ্ট, অবোধ্য কিছু শব্দ। গবেষকরা ভেবেছিলেন, এটি হয়তো মানসিক বিকারের সূচনা, তাই বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না।
কিন্তু দুই দিন পর পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। বৃদ্ধ চিৎকার করে জানায়, সে তার মৃত স্ত্রীর কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে, এবং শুধু তাই নয়, সে তার সাথে কথাও বলতে পারছে। গবেষকরা অবাক হলেও প্রথমে এটি অবিশ্বাস্য বলে মনে করলেন।
যখন সেই ব্যক্তি তাদের মৃত আত্মীয়দের নাম বলা শুরু করল এবং এমন ব্যক্তিগত তথ্য পুনরাবৃত্তি করতে লাগল যা কেবল তাদের প্রয়াত স্বজনরাই জানত, তখন গবেষণাগারের পরিবেশ একেবারে পাল্টে গেল। হতভম্ব হয়ে কিছু বিজ্ঞানী গবেষণাগার ত্যাগ করলেন, তাঁদের মুখে অস্ফুট ভয় আর দ্বিধার ছাপ।
সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। মৃতদের সাথে অন্তর্নিহিত কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার পর, বৃদ্ধ ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠল। সে বলল, মাথার ভেতরের কণ্ঠগুলো ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে। তার প্রতিটি জাগ্রত মুহূর্তে যেন শত শত কণ্ঠস্বর তার চেতনায় আঘাত হানছিল, তাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছিল না। একাধিকবার সে দেয়ালে নিজের শরীর আছড়ে ফেলে দিত, যেন কোনওভাবে ব্যথার প্রতিক্রিয়া অনুভব করে তার দুঃসহ অবস্থাকে সাময়িকভাবে ভোলাতে পারে।
তার আকুতি ছিল গবেষকদের প্রতি—শান্তির জন্য, নিদ্রার আশ্রয়ে কিছুটা মুক্তি পাওয়ার জন্য, সে প্রার্থনা করল ঘুমের ওষুধ। প্রথমে এটি কাজে দিয়েছিল। তিনদিন ধরে সে কিছুটা নিশ্চিন্তিতে থাকতে পেরেছিল। কিন্তু তারপরেই শুরু হলো ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। গভীর রাতে জেগে উঠে সে বলত, মৃতদের সে কেবল শুনতেই পাচ্ছে না, তাদের দেখতে পাচ্ছে, তাদের স্বর শুনছে স্বপ্নের জগতে।
আরেক দিন পেরোতেই, বৃদ্ধ আর সুস্পষ্ট কথা বলতে পারল না। পাগলপ্রায় হয়ে সে নিজের হাতে কামড়ে কামড়ে মাংস ছিঁড়ে ফেলতে লাগল। বিজ্ঞানীরা আতঙ্কিত হয়ে দ্রুত চেম্বারে ঢুকে তাকে বেঁধে রাখলেন, যেন সে আত্মহত্যা করতে না পারে। কয়েক ঘণ্টা পর, তার সব দেহের শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে এলো। সে হঠাৎ থেমে গিয়ে চিৎকার বন্ধ করে দেয়। সিলিংয়ের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আর নীরব অশ্রু তার মুখ বেয়ে নামতে থাকে।
এই অবস্থা এতটাই দীর্ঘায়িত হয় যে, বিজ্ঞানীদের বাধ্য হয়ে তাকে বারবার হাতে জল দিয়ে সজীব রাখতে হয়। ক্রমাগত কান্নায় তার শরীর থেকে এত বেশি তরল নিঃসরিত হতে থাকে যে স্বাভাবিক উপায়ে আর হাইড্রেশন বজায় রাখা সম্ভব হয় না। দুই সপ্তাহ ধরে এমন চলতে থাকে। তারপর একসময় সে মাথা ফিরিয়ে, অন্ধ চোখেও যেন এক বিজ্ঞানীর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়।
“আমি ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলেছি,” সে ফিসফিস করে বলল, “তিনি আমাদের পরিত্যাগ করেছেন।” বাক্যটি মেঘের মতো ছড়িয়ে পড়তেই তার শরীর নিস্তব্ধ হলো।
মৃত্যুর পেছনে কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না।
অভ্র, যদি তুই এই চিঠিটা পড়িস, তাহলে বুঝে নে আমার সঙ্গে কিছু একটা ঘটেছে।
এখন তোর জানা জরুরি যে সেই বৃদ্ধ লোকটি ছিল তোমার দাদু, অর্থাৎ আমার বাবা! যদিও তাঁর শরীরের কোনও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নড়াচড়া করতো না, এমনকি শ্বাসও নিচ্ছিলেন না, তবুও তাঁর দেহ কখনও অবনতি হয়নি।
আমার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত, আমি প্রতিদিন তাঁকে দেখতে যেতাম।
আশ্চর্যের বিষয়, সেই দিন থেকে তাঁর বয়স একটুও বাড়েনি, অথচ আমি তাঁর চেয়ে অনেক বেশি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। এবার আসল কথায় আসি, সেই গবেষণাগারটি আমাদের নিজস্ব বাড়িতেই অবস্থিত। আমরা এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতাম যা সাধারণ সমাজের চোখে ভালোভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না, তাই আমাদের গোপনীয়তার স্তর ছিল অসাধারণ কঠোর। অদ্ভুত কারণে, সেই পরীক্ষার প্রতিটি সদস্যই স্মৃতিভ্রংশের শিকার হয়ে পড়েছে।
শুধু আমি ছাড়া..