Horror Stories, Stories

কুয়াশার চাদরের ওপারে – আসিফ

সাদা চাদরের ভিতরে থাকা বাপনের ঘুমন্ত শরীরটা কেঁপে উঠল একবার। তার অবচেতন মন বার বার ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করছে অশুভ কিছু একটার। কিন্তু এসির ঠান্ডা বাতাসে, আপাদমস্তক চাদরে ঢেকে ঘুমানোর আমেজ কিছুতেই ভেদ করতে পারছে না সেই ইঙ্গিত। ঘরের মধ্যে টিম টিম করে জ্বলছে একটা মৃদু নীলাভ আলো। ঘরের সমস্ত গরম শুষে নিয়ে নিঃশব্দে ঠান্ডা বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে এসি। জানালার কাঁচ ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে শীতল বাতাসের ধাক্কায়। সমস্ত আসবাব জড়সড় হয়ে পড়ছে। কারণটা শুধুই শীতল বাতাস, নাকি ভয়?

বাপনের ঘুমটা পৌঁছে গেছে এমন এক পর্যায়ে যে, পর্যায়ে ঘুম ভাঙতেও পারে আবার সে গভীর ঘুমে তলিয়েও যেতে পারে। একটা মৃদু ঠকঠক শব্দ তার অবচেতন মনে আঘাত হানছে হাতুড়ির মতো। মস্তিষ্ক এখনও পুরোপুরি বিশ্রামের ঘরে। তবুও আবছা ভেসে উঠছে কিছু একটা। ঘুমের মধ্যেই সে যেন ধাওয়া করছে সেটার পিছনে। তাকে জানতেই হবে বিষয়টা সম্পর্কে।

তার অবচেতন মন যেন বলতে চাইছে দুটো কথা। প্রথমত, সে আসলে একটা স্বপ্নের মধ্যে ডুবে আছে। দ্বিতীয়ত, এসব নিছক স্বপ্ন নয়। এই আধো অন্ধকার ঘরের পরিবেশটাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে অশুভ কিছু একটা। ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে ভয়। অত্যন্ত সাংঘাতিক রকমের পৈশাচিক ভয়।

এবার যেন শব্দটা অন্যরকম শোনাচ্ছে তার কানে। ঠকঠক নয়, অন্য কিছু। গরর গরর বা ওই জাতীয় কিছু। কোন ইলেকট্রিক ইঞ্জিন বা নিজের নাক ডাকার শব্দের মতো। কিংবা তাও নয়। আরও একটু সময় পরে বাপনের অবচেতন মন স্পষ্ট করে বুঝতে পারে শব্দটা। কোন প্রাণীর চাপা গোঙানি অথবা ক্রোধের সঙ্গে মিল আছে শব্দটার।

তার শরীরটা একবার শিউরে উঠতে চাইল মাথা থেকে পা পর্যন্ত। বোধহয় একবার চমকেও উঠল ঘুমের মধ্যে। সেই সঙ্গে গায়ের চাদরটা আরও ভাল করে জড়িয়ে নিল সে। শীতটা যেন আচমকা বেড়ে গেছে। এবং সেটা দুঃস্বপ্নের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুন।

খুব সাংঘাতিক কিছু নিশ্চয়। নইলে ঘুমের মধ্যে এত অস্বস্তি হওয়ার কথা নয়। তার অবচেতন মন জানে, ঘরের মধ্যে আবহাওয়া বেশ শীতল। উপরন্তু গায়ে পাতলা চাদরের প্রলেপ থাকায়, ঘুমের মধ্যে ব্যাঘাত ঘটার কারণ খুব একটা নেই। কিন্তু সেই আবছা বিষয় এবং শব্দটা ভারি গোলমাল করছে এখন। ইচ্ছে হচ্ছে ঘুম ভেঙে উঠে বসতে। হতে পারে এই সমস্ত ইঙ্গিত আসলে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য।

কিন্তু চোখ দুটো কিছুতেই খুলতে চাইছে না। যেন তারা মনে করছে, চোখ মেলে চাইলেই ভয়ঙ্কর কিছুর মুখোমুখি হতে হবে। এমন কিছু, যা সহ্য করার ক্ষমতা তাদের নেই। সেই সঙ্গে তার অবচেতন মন একথাও জানাচ্ছে যে, এখনই চোখ মেলে না তাকালে তার কপালে দুঃখ আছে।

এবার ইঙ্গিতটা ঠিকঠাক পৌঁছাল মস্তিষ্কের গভীরে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল বাপন। এবং সঙ্গে সঙ্গে তার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এ কোথায় রয়েছে সে? চোখের সামনে এমন পাতালের মতো অন্ধকার কেন?

পরক্ষণেই নাকের ডগায় চাদরের অস্তিত্ব টের পেল সে। হাঁফ ফেলে অনেকটা ধাতস্থ হল বাপন। উফ্! কি বিশ্রী ব্যাপার! ঘুমের ঘোরে কখন যে চাদর দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে ফেলেছে, তা বুঝতেই পারেনি সে। এবার পুরোপুরি সজাগ ও ধাতস্থ হয়ে সে খেয়াল করল ভীষণ শীত করছে তার। এসিটা বন্ধ করতে হবে। মুখের উপর থেকে চাদর সরাতে গিয়ে থমকে গেল সে।

এই অসময়ে তার ঘুম ভাঙল কেন?

এখন নিশ্চয় ভোর হয়নি। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজনও এসে পড়েনি। জল তেষ্টা, তাও তো নেই। গলা খুসখুস করছে না। তলপেটে চাপ পড়ছে না। তাহলে ঘুম ভাঙল কেন?

তার শরীরের ভিতরে কোথাও একটা কম্পন শুরু হয়েছে ততক্ষণে। সেটা খুব ভাল ভাবেই টের পাচ্ছে সে। এবার তার গলা শুকিয়ে আসছে। একটা চিনচিনে ব্যথা তলপেট থেকে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীর জুড়ে। মাথাটা ঘুরছে প্রচন্ড গতিতে। সেই সঙ্গে সিনেমার মতো চোখের সামনে ভেসে উঠছে কিছু দৃশ্য। যা অতি ঘৃণ্য এবং নৃশংস।

ঝট করে মুখের উপর থেকে চাদরটা সরাতেই বাপনের হৃৎপিন্ডটা লাফ দিয়ে চলে এল ঠিক গলার কাছে। সে টের পেল, প্যান্ট এবং বিছানা ভিজে গেছে প্রস্রাবে। বুকের উপর চেপে বসেছে ভয়। ভীষণ কুৎসিত দর্শন মৃত্যুভয়।

তার চোখ দুটো জ্বলছে প্রতিশোধের আগুনে। লম্বাটে মুখ হাঁ হয়ে গিয়ে ঝলসে উঠছে তীক্ষ্ণ স্বদন্ত। বেরিয়ে আসছে পাশবিক ক্রোধের চাপা হুঙ্কার। চার পায়ের ধারালো নখগুলো ক্রমশ চেপে বসছে বুকে-পেটে। লালায়িত জিভ চকচক করছে নরমাংসের লোভে।

বাপনের মনে পড়ে গেল ঘণ্টা তিনেক আগের কথা। বাড়িতে একা থাকার সুযোগে তার মনে জেগে ওঠে বিকৃত বাসনা। কিন্তু সেই বাসনা চরিতার্থ করার মাধ্যম হিসাবে বেছে নেওয়া যায়, এমন কেউ ছিল না কাছাকাছি। বাড়ির সকলেই গেছে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে। সে যায়নি কারণ, তার কিছু কাজ পড়ে গিয়েছিল হঠাৎ। সন্ধ্যার পর ভীষণ একা বোধ করছিল বাপন। তখনই ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা এক ধরনের নিষিদ্ধ বস্তু তার সেই একাকীত্ব দূর করতে সাহায্য করে। এবং সঙ্গে জাগিয়ে তোলে তার ভিতরে শুয়ে থাকা একটা নিকৃষ্ট পশুকে।

বাড়িতে সে ছাড়া প্রাণী বলতে ছিল তার বোনের ভীষণ আদরের কুকুর মিন্টু। বাপনের অমানুষিক বাসনার সবটুকু সে উজাড় করে দিয়েছিল দেড় বছর বয়সী মিন্টুর শরীরের উপরে। এবং তারপর তার মাথায় লাঠির আঘাত করে, তাকে হত্যা করে ফেলে দিয়েছিল ছাদ থেকে বেশ খানিকটা দূরে।
যাতে পরদিন সবাই বুঝতে পারে যে, ছাদ থেকে কোনভাবে পড়েই মারা গেছে কুকুরটা।

কিন্তু এখন বাপনের অবস্থা দারুণ শোচনীয়। তার বুকের উপর বসে আছে সেই মিন্টু। তার মাথার বাঁদিকে একটা বীভৎস ক্ষত। সেখান থেকে কালচে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে বাপনের বুকের উপরে। গা গুলিয়ে উঠছে তার। ভয়ে গোটা শরীর অসাড় হয়ে গেছে। কুকুর মানুষের ভাষা বোঝে ঠিকই। কিন্তু বাপন আর কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। মিন্টুর পাশবিক মুখটা বীভৎস একটা হাঁ করে ক্রমশ এগিয়ে আসছে তার টুঁটি লক্ষ্য করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *