Short Stories

পরিযায়ী-রিজওয়ান

সেদিন বৈশাখের দগদগে রোদে শহরের পথে পথে হেঁটে চলেছিলেন শত শত খেটে খাওয়া মানুষ। শ্রমের দীর্ঘ ক্লান্তি উপেক্ষা করে তারা তাদের ঘরে ফেরার সংকল্প করেছিলেন। চোখে জড়ানো ক্লান্তি, তবে মনের ভেতর অদম্য এক আকুলতা—ঘরের কাছে পৌঁছানোর। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল সেই ঘর, যেখানে অপেক্ষা করছে শান্তি। ভ্রমণ তাদের জন্য হয়ে উঠেছিল কষ্টের, কিন্তু গন্তব্যের কাছে পৌঁছানোর আশায় প্রত্যেকেই যেন নতুন করে বল পাচ্ছিলেন।

এই বিশাল কাফেলার একটি দলের পথ চলার মাঝেই একদিন তারা জাতীয় সড়কের পাশে একটু বিশ্রাম নিতে থামে। দলের একজন, তরুণ জাভেদ, এগিয়ে গেল টেলিফোন বুথের দিকে। জামার পকেট থেকে এক টাকার কয়েন বের করে ডায়াল করল সে। ওপার থেকে শোনা গেল এক বৃদ্ধার কণ্ঠ:

“কে, জাভেদ?”

“হ্যাঁ, মা… তুমি কেমন আছ?”

“ভালো আছি বাপ। তুই কেমন আছিস?”

“আমি ঠিক আছি, মা। বাড়ির দিকেই আসছি। কিন্তু এত হাঁটতে হচ্ছে যে পা আর চলে না। তবে ঈদের আগে বাড়ি পৌঁছবই।”

বৃদ্ধা চিন্তিত গলায় বললেন, “সাবধানে আসিস। ট্রেন-বাস সব তো বন্ধ শুনছি।”

“হ্যাঁ মা, সব বন্ধ। কিন্তু তুমি চিন্তা কোরো না। ঠিক পৌঁছে যাব।”

একটু থেমে সলজ্জ গলায় জাভেদ জিজ্ঞেস করল, “মা, কুলসুম কেমন আছে?”

“ও তো কাল বাপের বাড়ি গেছে। আট মাসের গর্ভবতী মেয়েটা, এই সময় বাপের বাড়িতে থাকাই তো ভালো।”

“ঠিক বলেছ মা। আচ্ছা, এখন রাখি। আবার হাঁটতে হবে।”

“আচ্ছা বাপ। সাবধানে আসিস। দেখিস, তাড়াতাড়ি ফিরিস।”

ফোন রেখে জাভেদ আবার কাফেলার দিকে পা বাড়ায়। অন্ধকার পথে তার মনের গভীরে জ্বলতে থাকে একটাই আলো—বাড়ি ফেরার প্রতীক্ষা।

টেলিফোনের স্ক্রিনে সময় দেখাচ্ছে আটান্ন সেকেন্ড। আর দুই সেকেন্ড পর এক মিনিট হয়ে যাবে, তখন আবার এক টাকার কয়েন ফেলতে হবে। কিন্তু জাভেদ বড়ো হিসাব করে খরচ করছে। কষ্টে জ্বলছে তার পায়ের তলা, তবুও থামা চলে না। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে যায় মায়ের সেই সেদিনের মুখ। যখন সে বলেছিল, “মা, কাজের খোঁজে যাচ্ছি।” মা চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। বলেছিলেন, “হ, কাম তো করতে হইবই বাপ! কুলসমকেও তো তোকেই দেখবার হইব।”

মায়ের সেই কথা যেন প্রতিনিয়ত মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। এই ঈদে মা আর কুলসমকে নতুন কাপড় দিতে হবে—মনের কোণে এটাই বড়ো প্রতিজ্ঞা। গতবছর কিছুই দিতে পারেনি। বাবা ফজল মিঞা রেলে কাজ করতে গিয়ে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। সেদিন জাভেদের বয়স ছিল মাত্র চার। তারপর থেকে আমিনা দেবী, তার মা, অকল্পনীয় পরিশ্রম করে তাকে বড়ো করেছেন।

বীরভূম জেলার অখ্যাত এক গ্রামে তাদের সংসার। অভাবের চাপে জাভেদের স্কুলমুখী হওয়া হয়নি। চব্বিশ বছর বয়সে পাশের গ্রামের আক্তার হোসেনের মেয়ে কুলসমের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। একমাত্র মেয়েকে ভবিষ্যতে বসতবাড়ি আর এক বিঘা জমি দিয়ে যাবেন আক্তার সাহেব। কিন্তু শুধু এই ভরসায় সংসার চলবে না। তাই পাঁচ মাস আগে প্রতিবেশী অসীম ময়রার ছেলে সনাতনের সঙ্গে মজুরির আশায় মধ্যপ্রদেশ পাড়ি দিয়েছিল জাভেদ।

প্রথম দিকে কাজ ভালই হচ্ছিল। এই অঞ্চলে শ্রমিকদের মজুরি বেশ ভালো। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে এক অজানা ব্যাধির প্রকোপ শুরু হলো—করোনা। খুব দ্রুতই এই রোগ সমাজের উপর ছায়া ফেলল। কারখানা বন্ধ হয়ে গেল, কাজ হারাল অসংখ্য মানুষ। খাদ্যের অভাব ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে সবাই বাড়ি ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল।

সরকার বাস-ট্রেন সব বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়া নেওয়ার ক্ষমতা নেই জাভেদ কিংবা সনাতনের। ফলে তারা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আরও চারজন—মালতি, ফুলটুসি, চন্দ্রা এবং মালতির আট বছরের মেয়ে জবা। এদের সবাই বীরভূমের আশপাশের বাসিন্দা।

চন্দ্রা আর ফুলটুসি অনাথ। শৈশবে তাদের বাবা-মা মারা গেছেন, কারো চেহারাই মনে নেই তাদের। মাসীর কাছে মানুষ হয়েছে, কিন্তু মাসি মারা যাওয়ার পর সেই আশ্রয়ও হারিয়েছে। তাই মালতির সঙ্গে কাজের খোঁজে বেরিয়েছিল। মালতির কপালেও দুর্ভোগ কম নয়। তার স্বামী গতবছর দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, এরপর স্বাভাবিকভাবেই মালতি আর তার মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই হয়নি। গরিব বাবার পক্ষে আদালতের পথে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই মালতি মুখ বুজে তার ভবিতব্য মেনে নিয়েছে।

জবা জন্ম থেকেই কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। মেয়েটাকে জাভেদ বড়ো স্নেহ করে। গত পাঁচ দিনে তারা প্রায় একশ পনেরো কিলোমিটার হেঁটেছে। পুরো পথের বেশিরভাগ সময় জবা ছিল জাভেদের কোলে। মালতি একদিন বলেছিল, “দাদা, ওকে হাঁটতে দাও না কেন! এত রাস্তা কোলে নিলে তোমার কষ্ট হবে যে।”

হাঁটতে হাঁটতে জাভেদের পায়ের চামড়া ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। জবার শরীরের ভারে ক্লান্তি চেপে বসেছে তার দেহে। তবু জবার নিষ্পাপ মুখের হাসি দেখে সে নিজেকেই প্রবোধ দেয়, “না, না, কষ্ট আবার কিসের!”

সেদিন টেলিফোন বুথ থেকে বেরিয়ে ঘাম মোছার জন্য রুমাল বের করল জাভেদ। সামনের বাসের শেডে গিয়ে বসতেই সনাতন তার দিকে এগিয়ে দিল দুটি শুকনো রুটি। কিছুক্ষণ আগেই একটি সরকারি ত্রাণবাহী গাড়ি থেকে এগুলো তারা সংগ্রহ করেছিল। গত পাঁচদিন ধরে কেবল পানি ছাড়া কিছুই তাদের পেটে পড়েনি।

জাভেদ যখন রুটির টুকরো মুখে নিতে যাবে, তখনই সামনে এসে হাত বাড়ায় জবা। ক্ষুধার্ত মেয়েটির বড়ো বড়ো চোখে অনুনয়ের ছায়া। জাভেদ একটুও দেরি না করে নিজের হাতের রুটিটা তুলে দিল জবার মুখে। ক্ষুধার্ত মেয়েটি নিমেষেই সেটা গিলে ফেলে। জাভেদের মনে হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শত্রু এই ক্ষুধা। তবু জবার মুখে ফুটে ওঠা সন্তুষ্টির হাসি যেন তার কাছে ঈদের সবচেয়ে বড় উপহার।

সন্ধ্যা অবধি আরও খানিকটা পথ এগিয়ে তারা আবার একটি বাসের শেডে এসে আশ্রয় নিল। দিনের পরিশ্রম আর ক্লান্তিতে ঘুম আসতে দেরি হলো না।

মাঝরাতে এক অজানা তীব্র আওয়াজে তাদের চারপাশ কেঁপে উঠল। ঘুম ভেঙে ওঠার আগেই চারদিক ঢেকে গেল ধুলো আর অন্ধকারে। কারো চিৎকার, কারো কান্না, ভাঙা শরীরের তীব্র ব্যথায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পরিবেশ। তারপর নেমে এল এক নিস্তব্ধতা।

পরদিন টিভির পর্দায় স্থানীয় সংবাদে ভেসে উঠল এক হৃদয়বিদারক শিরোনাম—
“কলকাতা থেকে কিছু শ্রমিক বাস ভাড়া করে বাড়ি ফিরছিলেন। মাঝরাতে বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি শেডে আশ্রয় নেওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের পিষ্ট করেছে। বাসে থাকা কয়েকজন আহত, কিন্তু শেডের নীচে থাকা ছয়জন শ্রমিক মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে একটি শিশুও রয়েছে। তাদের পরিচয় এখনও জানা যায়নি।”

জাভেদ, সনাতনরা হয়তো এভাবেই মুক্তি পেলেন কষ্ট আর গ্লানি থেকে। কিন্তু পেছনে পড়ে রইল তাদের না পূরণ হওয়া স্বপ্নগুলো, মায়ের শূন্য চোখের দীর্ঘশ্বাস, আর এই বিশাল, বৈচিত্র্যময় বিশ্বসংসার, তার সব নির্মমতা নিয়ে।

Originally Written by Rizwan | ReFormatted by Ranjit Dutta Chowdhury

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *