Review of Riju Ganguly
এই সময়ের পাঠকের কাছে সৌরভ চক্রবর্তী মোটেই অপরিচিত নন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা রহস্য-রোমাঞ্চ-অলৌকিক ছোটোগল্প পাঠক ও সমালোচকের দ্বারা সমাদৃত হয়ে এসেছে বেশ কয়েক বছর ধরেই।
এবার, অবশেষে, এই সময়ের বাংলায় স্মার্ট, ঝকঝকে গ্রন্থনির্মাণে যারা নিজেদের উৎকর্ষ প্রমাণ করেছে বারংবার, সেই দিল জিতে নেওয়া কাফে টেবিলের সৌজন্যে লেখকের একঝাঁক গল্প ধরা পড়ল দু’মলাটের মাঝে এই আপাত সুমুদ্রিত, সৌজন্য চক্রবর্তী’র অসামান্য প্রচ্ছদে সুশোভিত হার্ডকভারে।
বইটাকে কেন ‘আপাত’ সুমুদ্রিত বললাম বলুন তো?
কারণ কাফে টেবিলের স্ট্যান্ডার্ডকে স্রেফ তুশ্চু করে এই বই জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র মুদ্রণ প্রমাদ, সংসদ বা আকাদেমির রীতিকে বুড়ো (বা মাঝের আঙুল) দেখানো ভুল বানান, দেওয়াল পত্রিকার স্তরের সিনট্যাক্স, এবং সম্পাদনা ও পরিমার্জনার সর্বাত্মক অভাব। এর ফলে এমন সুন্দর বইটা খুলে পড়তে বসলে শিউরে উঠতে হয়। আজকের পাঠকের জন্য এমন একটা বই পেশ করেছে কাফে টেবিল, এ বিশ্বাসই হতে চায় না।
কিন্তু, বানান ও প্রকরণের এই ধাক্কা উপেক্ষা করে বইয়ের গল্পগুলো পড়লে যে আশ্চর্য আলো-আঁধারি জগতে প্রবেশের সুযোগ মেলে, তা সর্বার্থে বিস্ময়কর।
সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর এই বইয়ে একে-একে এসেছে নিম্নলিখিত গল্পরা:
১] ক্লাউন আতঙ্ক
২] অসুখ করেছে কিংশুকের
৩] হোরেশিও, এমনি এক গল্প
৪] কংক্রিট
৫] ইকলিপস
৬] রঙ বদলে যায়
৭] মার্জার বিভীষিকা
৮] ব্রহ্মার খামখেয়ালি
৯] মাতৃরূপেণ সংস্থিতা (বানানটি সূচিপত্রেও ভুল ছাপা হয়েছে!)
১০] বিপাকে বটব্যাল
১১] রিল, নাকি রিয়েল!
১২] বোধন সেবার, বোধন এবার
১৩] ওহ-ভূত-পূর্ব!
১৪] বিট্টুর বাবুইকাণ্ড
১৫] সুনন্দ ও সবুজ বজ্র
১৬] ত্রিমাত্রিক ভয়
১৭] দ্য লাস্ট জাজমেন্ট
১৮] গল্পটা শুনতে নেই
১৯] বাঁধনছেঁড়া
২০] কোয়েল, হু’জ নেক্সট?
এর মধ্যে অত্যন্ত বেমানান ঠেকেছে ‘বিপাকে বটব্যাল’ এবং ‘বিট্টুর বাবুইকাণ্ড’। এই দু’টি গল্প পড়তে চমৎকার লাগলেও এরা একান্তভাবেই শিশুপাঠ্য, এবং সেজন্যই সংকলনের সামগ্রিক সুর ও তালের সঙ্গে এদের মেলানো যায় না। এদের পরিবর্তে রহস্যভেদী সব্যসাচীর গল্প ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ এবং সন্দেশ-এর পাঠকদের চমকে দেওয়া ‘শেষ গল্প’ এই সংকলনে স্থান পেলে তা যথাযথ হত।
অন্য গল্পদের মধ্যে সবগুলো আমার একই রকম ভালো লাগেনি, কিন্তু যেগুলো লেখেছে সেগুলোর বিশেষত্ব দ্বিবিধ:
প্রথমত, লেখক এই গল্পগুলোয় অলৌকিকের আশ্রয় নেননি। বরং তিনি মানবমনের অন্ধকার দিকগুলোকে অল্প কথায় ফুটিয়ে তুলেছেন। এর ফলে চরিত্ররা, এমনকি পাঠকেরাও একটা কালো আয়নার সামনে দাঁড়াতে বাধ্য হন। এর ফলে তাঁরা নিজেদের সম্বন্ধে এমন অনেক কিছু বোঝেন, যা তাঁরা জানতেন না, বা জানলেও মানতেন না।
দ্বিতীয়ত, খুব মিনিমালিস্ট ভঙ্গিতে লেখা কয়েকটি গল্পে লেখক পাঠকের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে তাঁকে নিজের মতো করে গল্পটা বুঝে নিতে দিয়েছেন। বাংলা ছোটোগল্পের ন্যারেটিভ কাঠামোয় ওপন-এন্ডেড কাহিনি পাঠকের দ্বারা সমাদৃত হয় না। কিন্তু সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ধাঁচে লেখা বলেই গল্পগুলো শুধু মনে দাগই কাটে না, বরং প্রায় টোয়াইলাইট জোন-এর কোনো এপিসোড দেখার মতো অনুভূতিরই জন্ম দেয়।
তবে এসব ছেড়ে দিন। ভুলে যান রোমাঞ্চ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সীমায় দাঁড়িয়ে গল্পের শেষের চমকের জন্য অপেক্ষা করা, সব্যসাচীর সঙ্গে পা মিলিয়ে খুনিকে খুঁজে বের করার দৌড়। এই সংকলন আমি মনে রাখব স্রেফ দুটো গল্পের জন্য: ‘ব্রহ্মার খামখেয়ালি’ আর ‘বাঁধনছেঁড়া’। কেন? তা জানতে গেলে তো আপনাকে বইটা পড়তে হবে।
আজ্ঞে হ্যাঁ, যদি আপনি প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের জন্য লেখা স্মার্ট, বুদ্ধিদীপ্ত, যৌক্তিক গল্প পড়তে চান, তাহলে এই বইটি অবশ্যপাঠ্য।
শুভেচ্ছা রইল।
Reviews
Clear filtersThere are no reviews yet.