Horror Stories

রক্তকরবী – শোভন কাপুড়িয়া

“রক্তকরবী”, এরকম কোনো বাড়ির নাম আবার হয় নাকি! হ্যাঁ হয়, আমি থুড়ি আমরা যে বাড়িতে থাকি সেটার নাম এটাই। নামটা কোনকালে রাখা হয়েছিল, সে কথায় আর গেলাম না। এটুকু বলতে পারি যে কোনো এক সময় বাড়িটার চারপাশে রক্তকরবীর গাছ হয়েছিল অনেক, হয়তো তাই এবাড়ির এই নাম!

বাড়িটা দেখতে পুরোনো দিনের রাজপ্রাসাদের মতো.. সিংহদুয়ারের পরে সুবিস্তৃত বাগান পেরিয়ে এই বাড়ির প্রবেশ দ্বার, তবে সেই বাগানের শ্রী আর নেই। বাগানের সমস্ত গাছ গুলো শুকিয়ে গেছে..ফুল ঝরে পড়েছে..আসলে জল দেওয়ার তো কেউ নেই। ভিক্টোরিয়ান আদলে তৈরী এই বাড়িটা ১৮০৫ সালে, বংশ পরম্পরায় জমিদার বংশের থেকে আমি। শয়ে শয়ে ঘর..বড় বড় ফটক..লম্বা থাম। সে যাই হোক, অনেক বছর ধরে এখানে রয়েছি আমরা..আমি আর আমার স্ত্রী। তবে আমরা না বড্ড একা, আশেপাশে কোনো লোকজন থাকেনা কথা বলার জন্য, দিনভর দুজন দুজনের মুখ দেখতে আর কতক্ষন ভালো লাগে। সেই যে কবে কোনো মানুষের মুখ শেষ দেখেছিলাম.. মনে পড়েনা। ইচ্ছে তো করে কারোর সাথে মিশতে, খাওয়া দাওয়া করতে, গল্প করতে।

আসলে আগে অনেকেই থাকতো এই এলাকায়, গমগম করতো চারিদিক..রাতের বেলায় তো রিতিমত আড্ডা বসতো সামনের রাস্তার মোড়ের ওখানে চায়ের দোকানটার সামনে। এটা বলতে পারিনা যে আমাদের সাথে সকলে যে মিশতো, কিন্তু দূরের থেকে লোকজনকে দেখেই খুশী হোতাম যে মানুষ গুলোর মুখ তো দেখতে পাচ্ছি। আমাদের বাড়িটার এদিকে খুব বেশী লোকেরা আসতো-ও না, কানাঘুষোতে আমি শুনেছিলাম এখানকার মানুষজনদের মধ্যে একটা ভয় কাজ করতো নাকি। সবাই বলতো আমাদের বাড়িটা নাকি ভূতের বাড়ি, এই ভাবনার কি কারণ জানিনা। আমরা সত্যিই ভূত না..ভূতের সাথে কোনোই মিল নেই আমাদের, কিন্তু কেন যে লোকের মধ্যে এই বিশ্বাস এসেছিল তা জানা নেই। তাই লোকের এই যে ভুল বিশ্বাসটা ভাঙতে হতোই.. কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা নেওয়াই হয়ে গেলো আমাদের ভুল।

একের পর এক লোক গায়েব হতে শুরু করলো গ্রাম থেকে। গ্রামের লোকেরা তো নিজে থেকে আসবেনা আমাদের বাড়িতে, তাদের নিয়ে আসতে হতো। কিন্তু রাস্তার মধ্যে ওদের ডাকলে তো আর আসবেনা, তাই গভীর নিশুতি রাত গুলোতে গ্রামের মানুষেরা শুনতে শুরু করলো নিশির ডাক। আমার স্ত্রীর সেই কামনা ভরা আবেদন গ্রামের পুরুষদের বন্ধ দরজার ভেতর থেকে বের করে নিয়ে আসতে থাকলো। সেই ডাক তাঁরা উপেক্ষা করতে পারতোনা, তাঁদের স্নায়ুতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারতো সেই ডাক। তাঁরা যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকতো, কখন যে নিজের বাড়ি ছেড়ে তাঁরা এই রাজবাড়িতে এসে হাজির হতো বুঝতেও পারতোনা। সুন্দরী নারীর শরীরী  আবেদন যে পুরুষেরা উপেক্ষা করতে পারতোনা, তা নিজে আমি বারবার দেখেছি। আমার স্ত্রীর সাথে এই বাড়িতে গভীর রাতে অজান্তেই তাঁরা লিপ্ত হতো উত্তপ্ত শরীরী খেলায়, আর সেই খেলার মাঝেই পুরুষদের ঘাড়ে বসে যেত দুই সুতীক্ষ্ণ দাঁতের কামড়। ওফফফফ, সেই স্বাদ..গরম রক্তের স্বাদ। কত বছর পরে যে আবার সেই রক্তের স্বাদ পেতে শুরু করেছিলাম, শরীরটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলো। এর মাঝেই একটা ব্যাপার লক্ষ্য করতে শুরু করেছিলাম..গ্রামের পুরুষদের রক্ত না হয় আমরা শুষে নিচ্ছিলাম, কিন্তু গ্রামের মহিলারা আর বাচ্চারাও অদ্ভুত ভাবে গায়েব হতে থাকলো, পাওয়া যেতে লাগলো ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ.. বিশ্বাস করুন , এগুলো কিন্তু আমরা করিনি, উত্তর আমরাও খুঁজে পাইনি। আজ এই গ্রাম জনশূন্য, কোনো মানুষের চিহ্ন নেই যাদের রক্তে আমাদের ক্ষিদে মিটবে। কিন্তু আজ রাতে হয়তো মিটবে আমাদের রক্ত পিপাসা, শরীর ভরে উঠবে মানুষের গরম রক্তে..আমাদের বাড়ির থেকে ৫ মিনিট উত্তরে হাঁটলে একটা ছোটো বাড়ি পড়ে, সেখানে আজ দেখলাম দুজন এসে উঠেছে.. স্বামী ও স্ত্রী। ওদের আজ রাতে খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করে এসেছি, ওরাও দেখলাম খুশী খুশী আসতে রাজি হয়ে গেলো। মনে মনে হাসলাম..ওরা জানেও না যে ওদের সাথে আজ ঠিক কি ঘটতে চলেছে!

****

লোকটা নিজেকে রাজবাড়ীর বাসিন্দা বলে পরিচয় দিয়েছিলো, কালো কাপড়ে ঢাকা শরীর..যতটা সম্ভব চেষ্টা করছিলো সূর্যের রশ্মি থেকে বাঁচার..রক্তচোষাদের দুর্বলতা, মনে মনে একটু হেসেই উঠেছিলাম । সত্যি বলতে আমি জানতাম  যে এই গ্রামটাতে এখনো কেউ থাকে, আর ওঁরা যে রাজবাড়ীতেই আছে সেটাও আমি জানি। ওঁরা এই গ্রামে আছে বলেই আমাদের আসা..হি হি। বুঝেছিলাম যে ও আমাদের চিনতে পারেনি।

পূর্ণিমার রাত, পরিষ্কার আকাশ। চাঁদের আলোয় আমাদের চলার পথ যথেষ্ট আলোকিত হয়ে রয়েছে, ঝি ঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে ঝোঁপের ভেতর থেকে..রাস্তার দুই পাশের গাছ গুলো যেন হাওয়ার সাথে মাথা দুলিয়ে যাচ্ছে। বাড়িগুলো অন্ধকার, জীবনের কোনো চিহ্ন কোথাও নেই! চাঁদ টা আজ একটু বেশিই বড় আর লাল! ব্লাড মুন। যেখানে আমরা আমাদের ঘাঁটি গেড়েছি, সেখান থেকে বেশীক্ষণের পথ না রাজবাড়ী। তাই বেশীক্ষন লাগলোনা পৌঁছতে আমাদের। সিংহদুয়ারটা ঠেলে ভেতরে ঢোকার সময়েই বাড়িটার দিকে নজর পড়লো আবার, দোতলার বাঁ দিকের একটা ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। কাঁচের জানালা ভেতর থেকে বন্ধ, ঘরে যে দুজন আছে সেটা তাদের ছায়া দেখেই অনুধাবন করতে পারলাম। আমি আর আমার স্ত্রী একবার একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

দরজায় টোকা মারার দরকার পড়লো না, আপনা আপনি দরজা খুলে গেলো! “ক্লাসিক!” বলে নিজের মনেই হেসে উঠলাম। প্রকাণ্ড হলঘর, বড় বড় থাম। দেওয়ালে পুরোনো দিনের জমিদারদের ছবি। একটা ছবি দেখে আমার চোখ আটকে গেলো..ছবিটার দিকে এগিয়ে গেলাম। রাজা নৃপতি নারায়ণ রায়চৌধুরী, জন্ম ১৭৭৮.. মৃত্যু ১৮৬০। হুমমম, এই নৃপতি নারায়ণ-ই তাহলে এসেছিলো। রক্তপিপাসা তাহলে এখনো মেটেনি ওনার। ঘুটঘুটে অন্ধকার হলঘর পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম সিঁড়ির দিকে, সিঁড়িটা ঘুরতে ঘুরতে উপরে উঠে গেছে। দোতলার সেই ঘরটা থেকে একটাই গান ভেসে আসছে, কি গান বোঝা যাচ্ছেনা..গ্রামোফোনের পিনটা আটকে গেছে হয়তো। আগে আমার স্ত্রী উঠতে থাকলো, তাঁর পরে আমি।

দোতলার ঘরটায় পৌঁছতেই দেখি নৃপতি আর সম্ভবত তাঁর স্ত্রী অনেক রকম খাবারের আয়োজন করে বসে আছে।

– আপনাদের আসতে অসুবিধা হয়নি তো! নৃপতি জিজ্ঞেস করলো।

আমি “না” জানালাম। আমার স্ত্রীর সাথে নৃপতির স্ত্রী ভাব জমানোর চেষ্টা করলো..চেষ্টা এই কারণেই বললাম কারণ তাঁর নজর কিন্তু আমার দিকে। সে ইচ্ছে করেই মাঝে মাঝে দেখি ঝুঁকে পড়ছে আর বুকের থেকে আঁচল খসে পড়ছে। নৃপতি ও যে সেটা চাইছেন, ভালোই বুঝতে পারলাম। ওনার স্ত্রী ভেতরের ঘরে চলে গেলো, সাথে আমার স্ত্রী-ও। নৃপতি আর তাঁর স্ত্রীর সম্ভাব্য শিকার যে আমরা, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ঠিক করলাম, আরো কিছুক্ষন খেলানো যাক।

– আচ্ছা নৃপতি বাবু! এই গ্রামে কোনো লোকজন নেই কেন?

শক টা লেগেছে দেখলাম, সে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো “আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?”

– ওই তো নীচে আপনার ছবি দেখলাম।

– (নৃপতির চোখ যে বিস্ময়ে ফেটে পড়লো বুঝলাম) এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেখলেন কি করে? টর্চ তো নেই আপনার কাছে!

– বলছি। তাঁর আগে আপনি বলুন না গ্রামের লোকজন নেই কেন?

– সবাই গায়েব হয়ে গেছে।

নৃপতির চোখে একটা হিংস্র জানোয়ারের মতো ভাব ফুটে উঠেছে। আমি নির্বিকার..

– হুমমমম, আপনারা তো খেয়েছেন পুরুষদের রক্ত খেয়েছেন, তাই তো! ১৮৬০ সালে আপনার মৃত্যু, তাঁর পর থেকেই রক্তচোষার জীবন!

– আপনি কে?

আমি জবাব দিলাম না, প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললাম “আপনি জিজ্ঞেস করছিলেন না যে আমি ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিভাবে দেখলাম! হুমমম.. ‌আপনি যখন এই গ্রামে পুরুষদের রক্ত খেয়ে বেড়াচ্ছিলেন..তখন মহিলাদের ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া যেতে থাকে। আপনি লক্ষ্য করেছেন কি না জানিনা, সেগুলো পূর্ণিমা আর ব্লাডমুনের দিনে শুধু হতো। আসলে কি জানেন তো, আমরা গ্রামের পর গ্রাম যাচ্ছি..সেখানকার মানুষদের কে তো মারছিই..আর তাঁর সাথে খুঁজে বেড়াচ্ছি আপনাদের মতো রক্তচোষাদের..হি হি.. চিরশত্রু বলে কথা!!!”

এরমধ্যেই হঠাৎ করে পেছন থেকে এক জান্তব শ্বাস-প্রশ্বাস শুনতে পেলাম। আমি ফিরে দেখলাম, এক লোমশ প্রাণী দাঁড়িয়ে.. রক্তাক্ত তাঁর মুখ..নখে তখনো মাংসের টুকরো লেগে আছে, বুঝতে অসুবিধা হয়না যে সেই মাংসের টুকরো নৃপতির স্ত্রীর । নৃপতির মুখ-ও ভয়ে ছোটো হয়ে গেছে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে কারণ আমার হাতটাও ধীরে ধীরে এক লোমশ হাত হয়ে উঠছে আর ধারালো হয়ে উঠছে নখ গুলো।

আমার শরীরের এই আকস্মিক পরিবর্তন দেখে নৃপতি দাঁড়িয়ে পড়ল, আমার এই পরিবর্তন যে তার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল সেটা তার মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম। ক্রূর হেসে বললাম “কী নৃপতি বাবু! এত অবাক হচ্ছেন যে! আপনি ভেবেছিলেন যে আমরা আপনার শিকার..” জানালা দিয়ে এসে পড়া চাঁদের আলোয় হাতের নখ গুলো চকচকে দেখাচ্ছে। নৃপতি ততক্ষণে নিজের স্বরূপ ধারণ করতে শুরু করেছে, আর অন্যদিকে আমি ও আমার স্ত্রী ততক্ষণে পুরোদস্তুর নেকড়ে মানবে পরিণত হতে চলেছি। নৃপতি কে আর বিন্দুমাত্র সময় না দিয়ে আমার স্ত্রী ঝাঁপিয়ে পড়ল রক্তচোষা নৃপতির ওপরে।

নৃপতি এক ঝটকায় তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। এই দৃশ্য দেখে আমার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে, প্রচণ্ড এক গর্জন করে নৃপতিকে আক্রমণ করি এবং হাতের পাঞ্জা দিয়ে তাকে যথেচ্ছভাবে আক্রমণ করতে থাকি। দুজনের মধ্যে ভীষণ এক পেশীর লড়াই শুরু হয়, দুজনেই জখম হতে থাকি একে অন্যের আঘাতে। তবে নৃপতির গায়ের শক্তি আমাকে ছাপিয়ে যেতে পারে না, নৃপতি নিজের ধারালো দাঁত আমার শরীরে বসাতে চেয়েও পারেনি। আমি নৃপতি কে একরকম পরাস্ত করলাম, তার সঙ্গে আরো কয়েকটা আঘাতের ফলে নৃপতি নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে। আমার স্ত্রী ততক্ষণে আবার মানুষের রূপে ফিরে এসেছে, নৃপতির দিকে একবার দেখে সে হেসে বলল “এই গ্রামের রক্তচোষা আপাতত শেষ হলো, চলো..এবার আমাদের তালিকায় থাকা পরের গ্রামে যাওয়া যাক।” নৃপতি এই জন্মের মতো রক্তচোষার জীবন থেকে মুক্তি পেল..

অপদেবতা || Apodebota – Sovan Kapuria

Original price was: ₹499.00.Current price is: ₹374.25.

নেমেসিস || Nemesis – Sovan Kapuria

Original price was: ₹599.00.Current price is: ₹449.25.

সপ্তকল্প || Saptakalpa – Sovan Kapuria

Original price was: ₹499.00.Current price is: ₹374.25.
author-avatar

About Sovan Kapuria

Sovan Kapuria, a tech expert and storyteller, blends his background in engineering with a flair for crafting gripping tales. Known for his works Web of Lies and Zodiac, he dives into themes of horror, sci-fi, and thrillers. When not driving innovation at Programmers.io, he’s weaving cinematic narratives that captivate readers worldwide.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *